পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আবার ঝুঁকির দিকে যাচ্ছে — সেনাবাহিনী এমনটাই বলছে। তাদের দাবি, ভারতপৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। ধর্ষণের নাটক সাজানো, ভাঙচুর-দাঙ্গা ছড়ানো, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে পাহাড়ে হামলা, চাঁদাবাজি আর অপহরণের মতো কাজগুলো এখন তাদের সক্রিয় তালিকায় রয়েছে।
সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এই অবস্থায় পার্বত্যাঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করতে অন্তত আড়াইশটা নতুন সেনা ক্যাম্প লাগবে
অন্য উপায় নেই। তাদের যুক্তি, নতুন ক্যাম্প হলে প্রতিটি রুটে সেনা তত্ক্ষণাৎ উপস্থিত হতে পারবে, অস্ত্র যাচ্ছে কোথায় তা আটকানো যাবে, আর চাঁদাবাজি-অপহরণও অনেকটাই ঠেকানো যাবে।
সেনা কর্মকর্তারা বলছেন, শান্তিচুক্তির পর অনেক ক্যাম্প পেতে কমে যাওয়ায় সশস্ত্র দলগুলো আবার শক্তি সঞ্চয় করেছে। এখন তারা খুলে চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড করছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা চাঁদা তুলেছে; তার মধ্যে ইউপিডিএফের পারিশ্রমিক টেনেছে ১০৪ কোটি টাকার কাছাকাছি। চাঁদার আওতায় পড়ে সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, কৃষক, চলাচলের যানবাহন, ঠিকাদার, কাঠ-বাঁশসহ নানা খাত।
জেলা ভিত্তিতে দেখলে রাঙামাটি থেকে সবচেয়ে বেশি প্রায় ২৪৪ কোটি, খাগড়াছড়ি থেকে ৮৬ কোটি এবং বান্দরবান থেকে ২০ কোটি টাকার মতো চাঁদা উঠেছে — সেসবও সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা রিপোর্ট বলে। শুধু চাঁদাই নয়; অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডেও ইউপিডিএফের নাম উঠে এসেছে। ২০০৯ সাল থেকে তারা ৩৩২ জনকে অপহরণ করেছে এবং ওই সময়ে ৮৯ জন হত্যার শিকার হয়েছে যেখানে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষও আছেন, এবং সেনাবাহিনীর ১৬ জন সদস্যও নিঃসন্দেহে মারা গেছেন।
সেনাবাহিনী বলছে, ইউপিডিএফ ও সহযোগীরা ভারতের মিজোরাম থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে ঢুকছে। সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ক্যাম্প বাড়ানো অপরিহার্য। এখনই খাগড়াছড়িতে ৯০, রাঙামাটিতে ৭০ ও বান্দরবানে ৫০ মিলিয়ে মোট ২১০ ক্যাম্প আছে — কিন্তু পাহাড়ের বিস্তৃতি, রাস্তা-ঘাট ও ভৌগোলিক কারণে এটা যথেষ্ট নয়। তাই আরও অন্তত আড়াইশটা ক্যাম্প লাগবে, যাতে সন্ত্রাসীরা আর মাথা তুলতে না পারে — সেনারা এতটাই বিশ্বাস করে।
সেনা সদর সূত্র জানায়, পূর্বে সরকারের নীতির কারণে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে কিছুটা ছাড় দেওয়া হতো, ফলে তারা রাজনৈতিক আড়ালে শক্তিশালী হয়েছিল। এখনকার নীতি ‘নো কম্প্রোমাইজ’ কোনো আপস নেই, সরাসরি অ্যাকশনই একমাত্র উপায়। কারণ এই গোষ্ঠীগুলো কখনোই সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না; তারা পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় সমাজকেই জিম্মি করে রেখেছে।
খাগড়াছড়ি জোনের এক লেফটেন্যান্ট কর্নেল বলেন, ধর্ষণের নাটক সাজিয়ে সাম্প্রদায়িক তীব্রতা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে — আর এভাবে বড় কোনো ঘটনা ঘটাতে পারে ভেবে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় অনেক জায়গায় ক্যাম্প না থাকায় সন্ত্রাসীরা ফাঁকফোকর কাজে লাগায়। এজন্যই আড়াইশটা ক্যাম্পের দাবি উঠেছে।
বান্দরবানে কর্মরত এক মেজর জানান, তাদের হাতে ইউপিডিএফের চাঁদাবাজি ও হত্যাকাণ্ডের নানা প্রমাণ আছে। তিনি বলেন, প্রতিটি রুট আমরা চিহ্নিত করেছি। নতুন ক্যাম্পগুলো হলে আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে যেকোনো স্থানে পৌঁছে অভিযান চালাতে পারব। রাঙামাটির এক জোন কমান্ডারও বলছেন, তাদের গোয়েন্দা রয়েছে যে ইউপিডিএফের ছয়টা ক্যাম্প মিজোরামে আছে; সেখান থেকেই মানুষ ঢুকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে নাশকতা চালায়।
খাগড়াছড়িতে দায়িত্বে থাকা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ বলেন, নতুন ক্যাম্প স্থাপন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারে, তবে সেনা এখন তাদের যতটা সামর্থ্য আছে, তাতে নজরদারি চালাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ধর্ষণের ঘটনা ব্যবহার করে সাধারণ পাহাড়ি নারীদের ও শিক্ষার্থীদের সামনে দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করা হতে পারে — তাই সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান সন্ত্রাসী তৎপরতা — চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড — একটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ক্যাম্প কমিয়ে নেওয়ার নির্দেশে কেন ফিরে যাওয়া হবে — এমন প্রশ্নও তুলেছেন তিনি, এবং বলেছেন, “আমরা আমাদের কৌশলে এগিয়ে যাব।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শহীদুজ্জামান বলছেন, মিজোরাম ও ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটছে — যা উদ্বেগের। সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও কার্যকর নজরদারি ছাড়া দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যাবে না। তাই আড়াইশটা নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপন এখন একান্ত জরুরি — সেনারা বলছে, এসব করলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখানো ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম দমন করা সহজ হবে।